Header Ads

Header ADS

| মানবধর্ম।

মানবধর্ম 
ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী

প্রথমে, ধর্ম কাকে বলে- সে সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু আলােচনা করে, পরে মানব ধর্ম বলব সংস্কৃত ভাষা থেকে ধর্ম' কথাটা এসেছে ধর্ম শব্দটি সম্পর্কে কি বলেছেন আমাদের শাস্ত্রকারগণ, তা বুঝতে হলে একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে  যত সহজ আমরা ভাবছি তত সহজ নয় তাছাড়া এ পথে বিপুল বাধা ইংরেজি ভাষার অভিধানে ধর্মের ইংরেজি রিলিজিয়া (religion) এটা একটা মারাত্মক ভুল সাহেবরা আমাদের দেশে এসে আমাদের শাস্ত্রের বহু ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তাতে যেমন উপকার হয়েছে তেমনি অপকারও কম হয়নি একটা বড় ক্ষতি হলাে- ধর্মের ইংরেজি অনুবাদ রিলিজিয়া যাঁরা সংস্কৃত জানেন না, ইংরেজির মারফৎ সংস্কৃত সাহিত্য ইত্যাদি বুঝতে চান, ধর্মকে রিলিজিয়া ভেবে তারা একটা বিরাট ভুল করেন কতখানি যে ভুল করেন, তা বলার নয় আলাচন করতে করতে ক্রমশ ব্যক্ত হবে 
যদি বলি যে, জলের ধর্ম তৃষ্ণা নিবারণ করা, আগুনের ধর্ম দহন করা- তাহলে কি বললাম বুঝতে পারছেন? এখন ইংরেজি করুন- religion of water is to quench thirst, religion of fire is to burn- এখন দেখুন ইংরেজিওয়ালারা, ঠিক হয়েছে কিনা অগ্নির ধর্ম দগ্ধ করা' কথাটা কিন্তু ভুল হল না কিন্তু আপনি যত বড়ই ইংরেজিওয়ালা হন না কেন, ঠিক করে বলতে পারবেন না যে, এ কথার ইংরেজি কি হলে ঠিক হয় এমন কোন শব্দ ইংরেজিতে নেই এক কথায় ধর্ম শব্দটা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদযােগ্য নয় কোন বস্তুর ধর্ম বলতে সে বস্তুর স্বভাব বা স্বরূপ বুঝায় অগ্নির ধর্ম দগ্ধ করা’- একথায় কি বুঝায় ? দগ্ধ করাই অগ্নির স্বভাব তার কাজই দগ্ধ করা, দগ্ধ না করলে সে নেই- এটাই তার ধর্ম  আগুন  জ্বলছে, কাঠ ফুরিয়ে গেল দেখে আপনিই আগুনকে বললেন- আপনি একটু বসুন,আমি বাজার থেকে কাঠ নিয়ে আসি আপনি ফিরে এসে দেখেন আগুন চলে গেছে  দগ্ধ করার বস্তু নেই, সুতরাং আগুনও নেইতার কাজই দগ্ধ করা এটাই তার স্বভাব এটাই তার স্বরূপ ইংরেজিতে একে বলে essential property বা inherent quality ইত্যাদি অর্থাৎ যেটা না থাকলে সে থাকে না, মােটামুটি সেটাই তার ধর্ম- এটাই ধর্ম কথায় শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা 

এ সংসারে সকল বস্তুরই একটা ধর্ম আছে সূর্যের একটা ধর্ম আছে সে আলাে দেয়, তাপ দেয় ইত্যাদি বাতাসের একটা ধর্ম আছে সে প্রবাহিত হয় এবং আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া করে মেঘের ধর্ম- সে বর্ষণ করে পশু-পাখির ধর্ম আছে একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর ধর্ম আছে, একটা অক্সিজেন পরমাণুর ধর্ম আছে এমন একটা বস্তু নেই, যার ধর্ম নেই বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়  property ধর্ম ছাড়া কোন বস্তু নেই এখন আপনি ধর্ম মানেন আর না-ই মানেন,
.....................................................
01
ধর্ম বাদ দিলে কোন জিনিসেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না ধর্ম আছে বলেই কুকুর কুকুরের মতাে, বিড়াল বিড়ালের মত, বাঘ বাঘের মতাে বাঘ তার ধর্ম পালন করে, বিড়াল তার ধর্ম পালন করে, বৃক্ষ-লতা তাদের ধর্ম পালন করে এবং ধর্ম পালন করে বলেই তারা আছে, না হলে তারা থাকে না সংসারে যাবতীয় বস্তুর এবং সমষ্টিযুক্ত বস্তুর একটি বিশেষ প্রকারের স্বভাব আছে এবং যার যে স্বভাব, সেটিই তার ধর্ম ধর্ম কি তা মােটামুটি বলা হল  এবারে বলব মানবধর্ম বলতে আমরা কি বুঝি 

যদি জল নিয়ে বসতাম, তাহলে জলের ধর্ম বলতাম; যদি বৃক্ষলতা নিয়ে বসতাম তাহলে তাদের ধর্ম বলতাম; যদি প্রাণীতত্ত্ব নিয়ে বসতাম তাহলে প্রাণীর ধর্ম নিয়ে আলােচনা করতাম মানুষের প্রসঙ্গ হচ্ছে, তাই মানুষের ধর্ম কি তাই বলার চেষ্টা করতে হবে যে-সব গুণ থাকলে মানুষকে মানুষ বলা হয় এবং না থাকলে মানুষ বলা চলে না, যা চলে গেলে সে আর মানুষ থাকে না- সেটাই মানুষের ধর্ম যে গুণ বা গুণের সমষ্টি থাকলে মানুষকে মানুষ বলা চলে, বলা উচিত- তা কি? খুব সাংঘাতিক একটা কিছু নয়- সেটার নাম মনুষ্যত্ব যেমন জলের জলত্ব থাকবে, অগ্নির অগ্নিত্ব থাকবে, তেমনি মানুষেরও থাকা দরকার মনুষ্যত্ব মানুষ আর পশু প্রায় একই বিশেষ করে medical science-এর দৃষ্টিতে পশু আর মানুষের কোন ভেদ নেই দেখছেন না, নতুন কোন ঔষধ আবিস্কৃত হলে প্রথমে তা পশুর দেহে পরীক্ষা করা হয় পশুর ব্যাধি যদি সারায় তবে ঘােষণা করা হয়, মানুষের দেহেও লাগবে হয়ত ডােজের একটু পার্থক্য হতে পারে তাহলে পশুতে আর মানুষে তফাৎ কোথায়? আমাদের শাস্ত্রীয় ভাষায়- ধর্মের্ণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ মানুষ মাত্রেরই ধর্ম মনুষ্যত্ব এটাই তার বিশেষত্ব এটা যদি না থাকে তবে সে পশুর সমান একথা শাস্ত্র বলছে আমরা যদি কোন মানুষকে পশু বলি, তাহলে তৎক্ষণাৎ সে মারতে আসবে, না হয় নালিশ করবে মানহানির সুতরাং মানুষকে পশু বলতে আমাদের ভয় হতে পারে, কিন্তু শাস্ত্রের তাে আর সে ভয় নেই তাই সে নির্ভয়ে ঘােষণা করছে, মনুষ্যত্ব নামে একটা গুণ, যদি দেখ যে এটা নেই,তাহলে তাকে মানুষ বলতে পারা যায় না 
আহার-নিদ্রা-ভয় মৈথুনঞ্চ সামান্যমেতৎ পশুভির্নরাণাম্
ধর্মো হি তেষামধিকো বিশেষাে ধর্মের্ণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ' 
 মানুষ্যত্ব বিহীন মানুষে আর পশুতে কোন পার্থক্য নেই শুধু খাই-দাই, ঘুমাই আর বংশবৃদ্ধি করি- এতাে পশুতে ও করে তাহলে তাে মানবও একপ্রকার পশু ইংরেজিতে rational কথাটি দিয়ে মানুষ আর পশুতে পার্থক্য বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের বুদ্ধি আছে, কিন্তু পশুরও বুদ্ধি কম নেই মানুষের ধর্মে আর পশু-পাখিদের ধর্মের পার্থক্য এই যে, পশু-পাখী তাদের ধর্ম নিয়েই জন্মায়, আর মানুষ তার ধর্ম নিয়ে জন্মায় না মনুষ্যত্বটা মানুষকে অর্জন করে নিতে হয় আর একটু বৈশিষ্ট্য আছে- Evolution theory মতে এককোষী
02
...............................................................
 প্রাণী থেকে মানুষ পর্যন্ত আসতে পথে তার অনেক জিনিস হারিয়ে গেছেপাখীদের মত সে উড়তে পারে না, মাছের মত জলের নীচে থাকতে পারে না, বাঘের মত দাঁত-নখ তার নেইএত জিনিস হারিয়েও সে অনেক লাভবান হয়েছেসে এখন কাচা খায়না, রান্না করে খায়, অন্ধকারে থাকে না, আলাে জ্বেলে নেয়অর্থাৎ মনুষ্যত্ব লাভ করার যাবতীয় উপকরণ বা উপাদান তাকে দেওয়া হয়েছে- এখন তাকে মনুষ্যত্বটা অর্জন করে নিতে হবেদাতা যিনি, তিনি ভুল করেননিঅতএব, মানুষকে জানতে হবে- মনুষ্যত্বটা কি এবং কি করে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়; এটাই মানবধর্ম আলােচনার সার কথাএবারে মনুষ্যত্বটা কি- তাই বলবআমার বুদ্ধি দিয়ে বলব না, শাস্ত্র অনুসারেই বলবমানব ধর্মকথাটা আমাদের শাস্ত্রের ভাষামনুর একখানা পুঁথি আছে, তার নাম মানব ধর্মশাস্ত্র'মহাভারতেও মানব ধর্মের উল্লেখ আছেঅধুনাকালে রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কমলালেস্টার দিয়েছেন তার নামদিয়েছিলেন- মানুষের ধর্ম', অর্থাৎ religion of man'প্রভু জগদ্বন্ধু বলেছিলেন- আপনারা বেদ মানেন তাে? কি কি জাতি মানেন? আমি মানি এক মানবজাতি, পশুজাতি এইসব' মানবমাত্রই একটা জাতিতার মধ্যে ছােট-বড় ভেদের কোন অর্থ হয় নামানবজাতির ধর্ম কি? মানবধর্মসকলেরই এক ধর্মমানবধর্মতাছাড়া জনসমাজের মধ্যে যে ছােট বড়; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ইত্যাদি আছে এ তাে কোন ভেদ না- এদের শাস্ত্রীয় নাম বর্ণএখন যেমন জাতি অর্থে বুঝায়- এটা ইংরেজ জাতি, এটা জার্মান জাতি, এটা ফরাসী জাতি- এ তাে ঠিক নয়এসব জাতির ধর্মও আলাদা নয়মানবজাতির একটাই ধর্ম- মানব ধর্ম ধর্ম বাদ দিলে সর্বনাশআপনি আর মানুষ রইলেন নাএকথা যদি বলি- শিক্ষা হবে ধর্মহীন, তাহলে বুঝব ঐ শিক্ষায় ধর্ম থাকবে না, মানে- এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবেন তারা মনুষ্যত্ব লাভ করবেন নাসাবধান হােন! মনুষ্যত্ব লােপ পেয়ে যাবেস্টেট হবে ধর্মহীন, তার অর্থ হল, স্টেট যে হবে, অর্থাৎ যারা শাসন করবেন তাদের কোন ধর্ম থাকবে নামানুষের মনুষ্যত্ব না থাকার ফলে মানুষ চুরি করবে, মিথ্যা কথা বলবে, পরকে হিংসাকরবে, পরের ক্ষতি করবে অতএব তার জন্য তৈরি হউনমনুষ্যত্ব বাদ দিয়ে কোন institution তৈরি করাও যা, তার আগে অ্যাটম বােমা দিয়ে সব শেষ করে দেওয়াও তাইযারা এসব কথা বলেন তারা হয়ত ধর্ম কি তা বােঝেন না কি করে বােঝাব বলুন তাে? বড় বড় লােক বলছেন তাদের কথাই বা অস্বীকার করি কেমন করে? ধর্ম জিনিসটা রিলিজিয়ান নয় একথাপূর্বেবলেছিরিলিজিয়া এর অর্থটা পরে বলব আগে মনুষ্যত্ব কথাটার অর্থ বলার চেষ্টা করিশাস্ত্রের ভাষায় কিম্বা মহাপুরুষদের ভাষায় মনুষ্যত্বের দু'তিনটি সংজ্ঞা আছেসব চেয়ে ছােট সংজ্ঞাটি যাতে মাত্র পাঁচটি লক্ষণের কথা আছে সেটাই বলিমনুষ্যত্ব ধর্ম বলতে প্রধানত ; পাঁচটি গুণ বুঝায়



03
................................................................................

“অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ।।
এতৎ সামাসিকং প্রােক্তং ধর্মস্য পঞ্চলক্ষণম্ ॥”
 মনুষ্যত্বের পাঁচটি লক্ষণ হ’ল- চুরি না করা, শুচি থাকা, হিংসা না করা, সংযমী হওয়া এবং সত্যাশ্রয়ী হওয়া। কথা কয়টির একটু ব্যাখ্যা প্রয়ােজন। অহিংসার ব্যাখ্যা তাে গত পঞ্চাশ বছর বিরাটভাবে হয়ে গেছে। অহিং আচার্য জীবন দিয়ে অহিংসার ব্যাখ্যা করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর কথা বলছি। অহিংসার অর্থ মানুষকে হিংসা না করা, অর্থাৎ মানুষকে ভালবাসা, মানুষকে শ্রদ্ধা করা, মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দেওয়া এই তাে অহিংসা। হিংসা তাে পশুর | ধর্ম। রাস্তা দিয়ে একটা কুকুর যাচ্ছে, আপনার বাড়ির কুকুরটি তাকে দেখে ঘেউ | ঘেউ করে উঠল, তারপর আশ-পাশ থেকে আট-দশটা কুকুর এসে রাস্তার মধ্যে শুরু করে দিল কামড়াকামড়ি- রক্তারক্তি । সন্ধান করে দেখুন এর কারণ কি? কারণ কিছুই না, একটা কুকুর অমনি অমনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এবং যা ঘটে গেল, সেটা নিছক কুকুরের ধর্ম। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, পাশের বাড়ীর একটি লােক বেরিয়ে এসে আপনাকে মারতে আরম্ভ করল, ক্রমে বহু লােক জমে একটা বিরাট মারামারি হয়ে গেল। এখন যদি বলি, মানুষগুলি এখনও কুকুরের ধর্ম ছাড়তে পারেনি, তাহলে খুব অন্যায় হবে কি? মানুষ আজ সভ্যতার গর্ব করে। আকাশে উড়ছি, চাঁদে যাচ্ছি, জলের তলায় মাছের রাজ্য দখল করেছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষের মত হাঁটতে শিখিনি। একত্রে হাঁটব রাস্তা দিয়ে যাতে একটা মানুষের সাথে আর একটা মানুষের ধাক্কা না লাগে, সেই শিক্ষাটাই শুধু বাকি আছে। আকাশে উড়ছি, জলের তলায় চলছি কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষের মতাে হাঁটতে শিখিনি। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে, তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিতে হবে। শাস্ত্রের | ভাষায়
“আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যােহর্জুণ।” (গীতা ৬/৩২)
অপরের সঙ্গে যখন ব্যবহার করবে, তখন নিজেকে প্রমাণ রূপে ধরবে। অর্থাৎ আপনাকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছি, তখনই ভাবতে হবে সে কথাটা আপনি আমাকে বললে আমার কিরূপ লাগবে, ইংরেজি ভাষায়, “Do unto others as you wish | to be done”, নিজেকে মাপকাঠিতে রেখে অপরের সাথে ব্যবহার করবে- এর | চেয়ে সুন্দর কথা আর নেই। এর মধ্যেই সব কথা আছে, এর নাম অহিংসা।
অপরের সঙ্গে ব্যবহারের মাপকাঠির জন্য আর বিশ্বব্রহ্মান্ডের খোজার দরকারই | নেই, খোজার স্টি আপনার কাছেই রইল।। এবারে অচৌর্যের কথাটায় প্রবেশ করি। চুরি না করা। সবাই জানে। পরের দ্রব্য না বলে নিলে চুরি হয়। চুরি করা মহাপাপ-একথা বাল্যশিক্ষায় লেখা আছে। এ আর | বেশি কথা কি। মাঝে মাঝে বাল্যশিক্ষাও পড়ার দরকার হয়। যখন সমাজে চোরের সংখ্যা বেড়ে যায়, চোরে যখন দেশ ভরে যায়, চোরকে যে ধরবে সেও চোর, তাকে যারা শাস্তি দিবে, তারাও চোর, আপিল করব যার কাছে সেও চোর, তার উপরে যে









No comments

Powered by Blogger.